বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস, রোগীদের স্বার্থেই হাসপাতালে ফার্মাসিস্ট চাই-বিশ্বজিৎ তালুকদার

বিশ্ব-ফার্মাসিস্ট-দিবস-রোগীদের-স্বার্থেই-হাসপাতালে-ফার্মাসিস্ট-চাই

বিশ্বজিৎ তালুকদার,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল সেন্টার।

ডাক্তার ও ফার্মাসিস্টরা হলেন রোগীর স্বাস্থ্যসেবার বিকল্পহীন অবলম্বন। রোগীর রোগনির্ণয়ে ডাক্তাররা যেমন বিশেষজ্ঞ, ঠিক তেমনি ওষুধ নিয়ে বিশেষজ্ঞ হলেন ফার্মাসিস্টরা। একজন ডাক্তারের কাজ হলো রোগীর রোগ নির্ণয় করে একটি প্রেসক্রিপশন বা নির্দেশনা দেওয়া। আর ফার্মাসিস্টের কাজ হলো প্রেসক্রিপশন পুনঃপরীক্ষণ, ওষুধ তৈরি, রোগীকে বিতরণ এবং ওষুধের ব্যবহারবিধি ও সংরক্ষণ নিয়ে রোগীকে পরামর্শ প্রদান। উন্নত বিশ্বের সব দেশেই ডাক্তার ও ফার্মাসিস্টদের কাজের এমন সমন্বয়েই রোগীর চিকিৎসা প্রদান করা হয়। ফলে রোগীও পায় মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা। এ জন্য উন্নত দেশগুলোর স্বাস্থ্যসেবার মানও হয় অনেক উন্নত। 

ফার্মাসিস্ট একটি ইংরেজি শব্দ। এর বাংলা অর্থ ওষুধবিদ বা ওষুধ বিশেষজ্ঞ। বাংলাদেশের ১৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও ২৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি বিভাগ চালু রয়েছে। ১২টি সরকারি এবং ৪১টি বেসরকারী ইন্সটিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি (IHT) রয়েছে যেগুলো ০৩ (তিন) বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা-ইন-ফার্মেসি কোর্স চালু রয়েছে । 
  
ফার্মেসি শিক্ষাঃ-
পেশাজীবিদের তিনটি শ্রেনীতে বিভক্ত করা হয়েছে। সেগুলো হলো:
ক. গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট (এ গ্রেড)।
খ. ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট (বি গ্রেড)।
গ. ফার্মেসি টেকনিশিয়ান (সি গ্রেড)।

ক. গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট (এ গ্রেড)
বাংলাদেশে গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট (এ গ্রেড) হওয়ার জন্য আপনাকে অবশ্যই বাংলাদেশ ফার্মেসী কাউন্সিল কর্তৃক অভিস্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগ হতে স্নাতক (বি. ফার্ম) ডিগ্রী অর্জন করতে হবে। উচ্চমাধ্যমিকের পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হন ফার্মেসি বিভাগে। তাঁরা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ওষুধের প্রস্তুতি থেকে শুরু করে ওষুধের ব্যবহার পর্যন্ত বিষয়গুলোতে বিশদভাবে জ্ঞানার্জন করেন।

৪ বছর মেয়াদী ব্যাচেলর অব ফার্মেসি কোর্সের পাঠ্যক্রমটি ১৫৬ ক্রেডিট আওয়ারের চেয়ে কম নয় এবং ১৭০ ক্রেডিট আওয়ারের চেয়ে বেশি হবে না। ৫ বছর মেয়াদী ব্যাচেলর অব ফার্মেসি কোর্সের পাঠ্যক্রমটি ১৯৯ ক্রেডিট আওয়ারের চেয়ে কম নয় এবং ২১০ ক্রেডিট আওয়ারের চেয়ে বেশি হবে না।

বাংলাদেশ ফার্মেসী কাউন্সিল কর্তৃক অভিস্বীকৃত ব্যাচেলর অব ফার্মেসি (বি. ফার্ম) প্রোগ্রামের সময়কাল ৪ বছর পূর্ণকালীন বি. ফার্ম প্রোগ্রাম এবং ৫ বছর পূর্ণকালীন বি. ফার্ম প্রফেশনাল প্রোগ্রাম।

চার থেকে আট সপ্তাহের ইন-প্ল্যান্ট/ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রশিক্ষণ ফার্মেসি পাঠ্যক্রমের বাধ্যতামূলক অংশ।

কর্মক্ষেত্র,ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি, কমিউনিটি ফার্মেসি, হাসপাতাল, উপশম কেন্দ্র, জনস্বাস্থ্য, সশস্ত্র বাহিনী, সরকারী চাকুরীসহ আরও অনেক ক্ষেত্রে ফার্মাসিস্টদের কাজ করার সুযোগ রয়েছে।

খ. ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট (বি গ্রেড)
এসএসসি বা স্বীকৃত সমমানের পরীক্ষায় জীববিজ্ঞানসহ বিজ্ঞান বিভাগ হতে উর্ত্তীণ একজন শিক্ষার্থী তিন (০৩) বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা-ইন-ফার্মেসি প্রোগ্রামে আবেদন করতে পারবে। ডিপ্লোমা-ইন-ফার্মেসি কোর্সটি শেষ করার জন্য প্রার্থীকে অবশ্যই বাধ্যতামূলকভাবে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছয় মাসের ইন্টার্নশিপ করতে হবে। 

বাংলাদেশে, বাংলাদেশ ফার্মেসী কাউন্সিল কর্তৃক অভিস্বীকৃত/অনুমোদিত ১২টি সরকারি এবং ৪১টি বেসরকারী ইন্সটিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি (IHT) রয়েছে যেগুলো ০৩ (তিন) বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা-ইন-ফার্মেসি কোর্স পরিচালনা করে থাকে। 

ডিপ্লোমা-ইন-ফার্মেসি কোর্স উর্ত্তীণ হওয়ার পর বাংলাদেশ ফার্মেসী কাউন্সিল কর্তৃক বি ক্যাটাগরিতে নিবন্ধিত হয়ে নিম্মোক্ত কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত হতে পারে:সরকারী এবং বেসরকারী হাসপাতালে, মডেল ফার্মেসি এবং মডেল মেডিসিন শপে,ক্লিনিক,এনজিও, কমিউনিটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে।

গ. ফার্মেসি টেকনিশিয়ান (সি গ্রেড)।
বাংলাদেশ ফার্মেসী কাউন্সিল ও বাংলাদেশ কেমিস্টস এবং ড্রাগিস্টস সমিতি যৌথভাবে মডেল মেডিসিন শপ স্থাপন/প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার বিষয়ে ফার্মেসি টেকনিশিয়ানদের (সি ক্যাটাগরি) জন্য ফার্মেসি সার্টিফিকেট রেজিস্ট্রেশন কোর্স নামে ০৩ মাস ব্যাপী একটি প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।

বাংলাদেশ ফার্মেসী কাউন্সিল এ ক্যাটাগরির ফার্মাসিস্টদের জন্য মডেল ফার্মেসি স্থাপন/প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার বিষয়ে ৩০ ঘন্টার একটি প্রশিক্ষণ কোর্স পরিচালনা করে থাকে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসারে, বিশ্বের ফার্মাসিস্টদের ৫৫ শতাংশ কাজ করবে ‘কমিউনিটি ফার্মাসিস্ট’ হিসেবে। ৩০ শতাংশ ফার্মাসিস্ট কাজ করবে হাসপাতালের চিকিৎসাসেবায়। ৫ শতাংশ কাজ করবে সরকারি সংস্থায়, ৫ শতাংশ শিক্ষাকার্যক্রমে এবং ৫ শতাং কাজ করবে কোম্পানির ওষুধ প্রস্তুতিতে। অথচ বাংলাদেশের ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ ফার্মাসিস্ট কাজ করছে ওষুধ কোম্পানিতেই! নেই কোনো হসপিটাল বা কমিউনিটি ফার্মাসিস্ট! দেশের ফার্মাসিস্টরা সফলভাবে ওষুধ প্রস্তুত করলেও সরাসরি রোগীর সেবায় ভূমিকা রাখতে পারছেন না। ফলে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ‘পুনঃপরীক্ষণ’ হচ্ছে না। এটি করা গেলে ওষুধ বিক্রিয়া, ডোজিং, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বিবেচনা করে চিকিৎসককে ওষুধ পুনর্বিবেচনার জন্য পাঠাতে পারতেন ফার্মাসিস্টরা। এতে রোগীর সঠিক ও কার্যকর চিকিৎসা হতো। হসপিটাল ফার্মাসিস্ট নিয়োগ হলে রোগীদের সঠিক ওষুধ বিতরণের পর ওষুধের ব্যবহারবিধি ও সংরক্ষণ নিয়ে বিস্তারিত পরামর্শ দিতে পারতেন ফার্মাসিস্টরা। তাতে ওষুধের যৌক্তিক ও নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত হতো। হসপিটাল ফার্মাসিস্টরা ওষুধের যাবতীয় প্রয়োজনীয় তথ্য ও প্রয়োগ নিয়ে ডাক্তার ও নার্সদের জানাতে পারতেন। ফার্মাসিস্টদের মাধ্যমে বাজারে নতুন আসা ওষুধগুলো নিয়ে ডাক্তাররাও ধারণা পেতে পারতেন। বয়স, ওজন, লিঙ্গ ও শারীরিক পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রত্যেক রোগীর জন্য উপযুক্ত ডোজে ওষুধ ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে পারেন কেবল হসপিটাল ফার্মাসিস্টরাই। এর বাইরে রিটেইল ফার্মেসি চালু হলে প্রেসক্রিপশনবিহীন ওষুধগুলোর ব্যবহার সম্পূর্ণ নিরাপদ করা যেত। এভাবে রোগীরা পেত নিরাপদ ও কার্যকর চিকিৎসা।

বাংলাদেশে ২০১৮ সালের মার্চ মাসে ‘হসপিটাল ফার্মাসিস্ট’ চালু করার একটি সরকারি গেজেট প্রকাশ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সেখানে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের প্রথম শ্রেণির নবম গ্রেডে সরাসরি নিয়োগের নির্দেশনা রয়েছে। এরপর ২০২০ সালের জানুয়ারিতে শূন্য পদের তালিকা সরকারি কর্ম কমিশনে প্রেরণের নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিন্তু পরবর্তী কার্যক্রম আর কারও দৃষ্টিগোচর হয়নি। আমলাতান্ত্রিকতার নিয়মে কোনো এক টেবিলে হয়তো আটকা পড়েছে হসপিটাল ফার্মাসিস্ট নিয়োগের ফাইল! স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও দেশের অসহায় রোগীদের জন্য এখনো বন্দোবস্ত হয়নি হসপিটাল ফার্মাসিস্টদের সেবা। ফলে রোগীর স্বাস্থ্যসেবা আজও অবহেলিত।

বাংলাদেশের ফার্মাসিস্টরা কেবল ওষুধ কোম্পানিতে ওষুধ প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। সেখানে তাঁরা রাখছেন তাঁদের মেধা ও দক্ষতার স্পষ্ট স্বাক্ষর। এ জন্যই আজ বাংলাদেশের ৯৮ শতাংশ ওষুধের চাহিদাই মেটাচ্ছে দেশীয় ওষুধ কোম্পানিগুলো। বর্তমানে বাংলাদেশের ২৫৭টি ওষুধ কোম্পানিতে প্রতিবছর ২৪ হাজার ব্র্যান্ডের ওষুধ উৎপাদিত হচ্ছে। বছরে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার ওষুধ ও কাঁচামাল উৎপাদন করছে কোম্পানিগুলো। দেশের চাহিদা মিটিয়ে ১৮২টি ওষুধ কোম্পানি এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে। শুধু ২০১৮-১৯ অর্থবছরেই ওষুধশিল্প থেকে ১৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়েছে। দেশের এই বিশাল সম্ভাবনায় ক্ষেত্রের কারিগর হলেন আমাদের ফার্মাসিস্টরা। দেশের এই দক্ষ ফার্মাসিস্টদের উন্নত দেশগুলোর মতো সরাসরি স্বাস্থ্যসেবায়ও যুক্ত করা গেলে চিকিৎসাসেবার মান দ্রুতই উন্নত করা সম্ভব।

পৃথিবীর বর্তমান করোনা দুর্যোগেও উন্নত বিশ্বের ফার্মাসিস্টরা রাখছেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন করোনা থেকে সুস্থ হয়েই হাসপাতালে কর্মরত ‘ওয়ান্ডারফুল ফার্মাসিস্ট’দের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানাতে ভোলেননি। তা ছাড়া পৃথিবীতে কোভিড-১৯–সহ অন্য যেকোনো রোগের ওষুধ বা ভ্যাকসিন এলে তার পরীক্ষামূলক ব্যবহার থেকে শুরু করে রোগীর মনিটরিং পর্যন্ত সব ধাপে কেবল ক্লিনিক্যাল ফার্মাসিস্টরাই নিশ্চিত করতে পারেন নিরাপদ ও কার্যকর প্রয়োগ। সে জন্য করোনা দুর্যোগেও ফার্মাসিস্টদের রয়েছে বিশেষ ও স্বতন্ত্র ভূমিকা। ফার্মাসিস্টদের অংশগ্রহণ ছাড়া এই দায়িত্ব অন্য কোনো পেশাজীবী সঠিকভাবে পালন করতে পারবেন না। তাই করোনা দুর্যোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও ফার্মাসিস্টরা হতে পারেন প্রথম সারির সৈনিক।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসারে, প্রতি এক হাজার মানুষের জন্য চাই একজন করে ডাক্তার ও ফার্মাসিস্ট। দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে এখন ৭০ হাজারের বেশি ডাক্তার কর্মরত। অথচ একজনও ফার্মাসিস্ট নেই! তাহলে স্বাস্থ্যসেবার দুর্গতি হবে না কেন?

সরকার ফার্মাসিস্টদের কাজে লাগাতে যত দেরি করবে, রোগীর সেবা এবং সর্বোপরি স্বাস্থ্য খাত তত পিছিয়ে থাকবে। ২০১৮ সালে যেহেতু ‘হসপিটাল ফার্মাসিস্ট’ নিয়োগের গেজেট প্রকাশিত হয়েছে, তাই আর দেরি না করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কিংবা সরকারি কর্ম কমিশনের মাধ্যমে দেশের ফার্মাসিস্টদের দ্রুত নিয়োগ দিতে হবে। তবেই রোগীর স্বাস্থ্যসেবা হবে নিরাপদ ও কার্যকরী। অন্যথায় বাংলাদেশের রোগীরা কেবল বঞ্চিতই হবে!

বিশ্বজিৎ তালুকদার,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল সেন্টার।