শকুনের কথা বর্তমান প্রজন্মের কাছে প্রায় অজানা

শকুনের-কথা-বর্তমান-প্রজন্মের-কাছে-প্রায়-অজানা

আশির দশকে বা তার আগে যারা গ্রামে বড় হয়েছেন তাদের অবশ্যই গরুর পালের কথা মনে আছে। তখন প্রতিটি গ্রামে ভাগাড় ছিল। যখন প্রাণীটি মারা যায়, এটি ফেলে দেওয়া হয় এসব ভাগাড়ে। আর এই ভাগাড়ে প্রধান যে পাখিটিকে দেখা যেত, তার নাম শকুন। মরা প্রাণী খেয়ে নিমেষেই সব পরিষ্কার করে ফেলত।

শকুন সম্পর্কে বহু অশুভ মিথের কথা শোনা যায়। কিন্তু শৈশবের সেই শকুন সম্পর্কে মানুষের বিভিন্ন স্মৃতি যেন ভুলে না যায়। সারাদিন শকুনের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। যখনই সে সুযোগ পায়, সে শকুনের দিকে পাথর নিক্ষেপ করে। এত কিছুর পরও ওই ভাগাড় ছেড়ে কিন্তু শকুনগুলো কখনোই পালিয়ে যায়নি। গাঁয়ের মানুষেরাও জানত এ শকুনগুলো চলে গেলে মরা পশুর গন্ধে টেকা অসম্ভব। আর রোগজীবাণুর বিস্তারও তো আছেই!

এখন গ্রাম-শহরের কোথাও শকুন নেই। সেই সময়ের মানুষের স্মৃতি থেকে শকুনের নাম প্রায় মুছে গেছে। এদেশের সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে শকুন বরাবরই অবহেলিত। সবাইকে একটু ভাবতে হবে, স্বাধীনতার সময় শকুন না থাকলে রোগের বিস্তার আরো অনেক বেশি হত।

শকুনের কথা বর্তমান প্রজন্মের কাছে প্রায় অজানা। জানবে কী করে? এই দেশে প্রায় ৫০,০০০ শকুনের মধ্যে মাত্র ২৫০ টি শকুন কোন না কোনভাবে টিকে আছে। এটি প্রধানত সিলেটের রেমা কালেঙ্গা এবং সুন্দরবনে দেখা যায়। আর পৃথিবীর প্রায় ৪০ মিলিয়ন শকুন এখন মাত্র ১১ হাজারে ঠেকেছে। শকুনের অভাবে এশিয়াজুড়ে জলাতঙ্কসহ বিভিন্ন রোগের প্রকোপ বেড়েছে। ভারতে এর বিস্তার প্রায় ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই রোগগুলি প্রতি বছর সাত হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করে। এই সংখ্যা এই দেশে কম নয়।

শকুন কেন মারা পড়ছে? এ–বিষয়ক গবেষণার ফল আমরা পেয়েছি ২০০৪ সালে। এর আগেই প্রকৃতি থেকে ৯৯ ভাগ শকুন হারিয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পশুচিকিৎসক লিডসে প্রথম আবিষ্কার করেন পশুচিকিৎসায় ব্যবহৃত ব্যথানাশক ডাইক্লোফেনাক–জাতীয় ওষুধের কারণেই সব শকুন মরে গেছে। এ ওষুধ পশুতে ব্যবহার করার ফলে সেই গরু মারা পড়লে আর শকুন যদি সেই মরা গরু খায়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে শকুন মরে যায়।

বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধান এবং গবেষকরা শকুন রক্ষার উপায় খুঁজছেন। জার্মান বিজ্ঞানী জারগার এবং তার ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি মেলোক্সিকাম নামে একটি ওষুধ আবিষ্কার করেন। এই ওষুধগুলি প্রাণীদের চিকিৎসায় খুবই কার্যকর এবং শকুনের কোন ক্ষতি করে না। শকুন রক্ষার জন্য পরে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং নেপালে ডিক্লোফেনাক নিষিদ্ধ করা হয়। ওষুধ নিষিদ্ধ হওয়ার পর, কেটোপ্রোফেন, এসিক্লোফেনাক এবং ফ্লুনিক্সিন সহ বেশ কয়েকটি ওষুধ বাজারে আসে, যা শকুনের জন্য সমানভাবে ক্ষতিকর। বাংলাদেশ সরকার এই বছর জানুয়ারিতে কেটোপ্রোফেন নিষিদ্ধ করেছে, যা শকুন রক্ষার একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ।

বাংলা শকুন টিকে থাকার লড়াই করছে। বন বিভাগ এবং আইইউসিএন বাংলাদেশ স্বল্প সংখ্যক শকুন রক্ষার উদ্যোগ নিয়েছে। শকুনের নিরাপদ খাদ্যের জন্য ফিডিং স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে। নিয়মিত নিরাপদ গরু এখানে সরবরাহ করা হয়। এছাড়াও, আহত শকুনের যত্নের জন্য একটি উদ্ধার কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি নিরাপদ ওষুধ মেলোক্সিকাম এবং সালফামেনিক এসিডের উৎপাদন বৃদ্ধি করেছে। শকুন রক্ষায় সরকার দুটি নিরাপদ এলাকাও ঘোষণা করেছে।

শকুন রক্ষার দায়িত্ব একমাত্র সরকার বা কোন সংস্থার নয়। বাংলার নামে বৈজ্ঞানিকভাবে যে পাখির নামকরণ করা হয়েছে তাকে রক্ষা করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে যদি ওষুধ কোম্পানিগুলো শকুন রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে, বাংলার আকাশে শকুনের নিয়মিত আগমন আবার ঘটতে পারে।