টিনএজারদের যেসব আচরণগত পরিবর্তন সঙ্কেত অভিভাবকদের জন্য

টিনএজারদের_যেসব_আচরণগত_পরিবর্তন_সঙ্কেত_অভিভাবকদের_জন্য
কিশোর বয়সী ছেলেমেয়েরা মানসিক রোগের অধিক ঝুঁকিতে থাকে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে যারা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগেন তাদের অর্ধেকের ক্ষেত্রেই সমস্যাটি শুরু হয় ১৪ বছর বয়সের মধ্যেই। বিশ্বব্যাপী ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ হচ্ছে আত্মহত্যা।

বেসরকারি এক জরিপে দেখা গেছে বাংলাদেশে যতজন আত্মহত্যার পথ বেছে নেন তাদের মধ্যে ১১ শতাংশ কিশোর বয়সী। অন্যদিকে জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ বলছে, করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারির কারণে দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ও ঘরে বন্দি থাকার বিশেষ প্রভাব পড়েছে শিশু-কিশোরদের উপর।

কিন্তু বাংলাদেশে এই বয়সীদের মানসিক স্বাস্থ্য গুরুত্ব সহকারে নেয়া হয় না। অন্যদিকে দেশে মানসিক চিকিৎসকের এমনিতেই মারাত্মক ঘাটতি রয়েছে।

কিশোর বয়সীদের জন্য স্কুল ভিত্তিক কোন কাউন্সেলিং-এর ব্যবস্থাও নেই। কিন্তু এই বয়সে ছেলেমেয়েরা মানসিক রোগের অধিক ঝুঁকিতে থাকে।

যে কারণে মনোরোগের ঝুঁকি কিশোর বয়সীদের 
মানসিক রোগকে উপেক্ষার প্রবণতা
বাংলাদেশের সমাজে অভিভাবকেরা এই বয়সী সন্তানদের মানসিক রোগ বিষয়টি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অসুখ বলে মানতে রাজি নন, বরং বেয়াড়াপনা বা উচ্ছন্নে যাওয়া বলেই মনে করে করেন, মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা।

যে কারণে কিশোর বয়সীরা মানসিক রোগের ব্যাপারে একটু বেশি ঝুঁকিতে থাকে সেটি ব্যাখ্যা করে তিনি বলছেন, "এই সময়টা তাদের হরমোন পরিবর্তন হয়। সে কারণে তারা অনেক বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে। এই কারণে তারা দ্রুত আনন্দ পায়, কষ্ট পায়, দ্রুত রেগে যায় বা ভয় পায়। এসব আবেগ অনেক বেশি থাকার কারণে সবকিছু তাদের উপর বেশি প্রভাব ফেলে।"

মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বয়ঃসন্ধিকালে সে যে শারীরিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায়, তাতে নিজেকে নিয়ে দ্বিধা তৈরি হয়। কিশোর বয়সে অনেক নতুন কিছুর সাথে হঠাৎ পরিচয় হয়।

মানসিকভাবে প্রস্তুত না হলেও মাসিক শুরু হওয়া, স্তনের গঠন বৃদ্ধি, শরীরের বিভিন্ন স্থানে বাড়তি লোম, গলার স্বর পরিবর্তন এসব হঠাৎ করেই বদলে দেয় পৃথিবী। এসব পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নিতে পারে না অনেকে।

কৈশোরে বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, রাগ, নিজের ক্ষতি হয় এমন কিছু করা, আত্মহত্যা প্রবণতা, মানুষের সাথে মেলামেশায় অস্বস্তি, নিজেকে নিয়ে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি দেখা দিতে পারে।

আবার উল্টো অতি আত্মবিশ্বাসী ও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে অনেকে। সে বড় হয়ে গেছে এমন ধারণা থেকে বাবা-মায়ের অবাধ্য হয়ে উঠতে পারে।

এই কারণে এই বয়সে ভুল হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। কিশোর বয়সে নিষিদ্ধ কিছুর প্রতি কৌতূহল থেকে অনেকে মাদকাসক্ত হয়ে ওঠে, পর্নোগ্রাফির দিকে ঝুঁকতে থাকে। পরবর্তীতে মানসিক স্বাস্থ্যের উপর এরও প্রভাব পড়তে পারে।

কিশোর বয়সীরা সামাজিক কারণেও মানসিক রোগের ঝুঁকিতে থাকে মনে করে করেন, মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা।

"অনেক সময় অভিভাবকেরা তাকে একবার বলবে তুমি বড় হয়ে গেছো এটা কেন করলে, আবার বলবে তুমি এখনো ছোট এসব নিয়ে তুমি কথা বলো না। এটা তার মধ্যে আরও বিভ্রান্তি তৈরি করে।"

এই সময় স্তন, মাসিক, বাড়তি লোম, গলার স্বর এগুলো নিয়ে অভিভাবক, আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশীরা যে মনোভাব প্রকাশ করে সেটিও কৈশোরে মনের উপর প্রভাব ফেলে।

"দাড়ি সুন্দরভাবে না গজালে, স্তন বেশি বড় হলে বা ছোট হলে যেসব কথা তাদের শুনতে হয় এটি কিশোর বয়সীদের মধ্যে আত্মসচেতনতা বাড়িয়ে দেয়।"

যেসব আচরণগত পরিবর্তনগুলো অভিভাবকদের জন্য সঙ্কেত-
মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের সমাজে অভিভাবকেরা এই বয়সী সন্তানদের মানসিক রোগ বিষয়টি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অসুখ বলে মানতে রাজি নন।

বরং বেয়াড়াপনা, উচ্ছন্নে যাওয়া এবং শাসন করলে ঠিক হয়ে যাবে বলে মনে করেন। তিনি বলছেন, কিছু আচরণগত পরিবর্তন রয়েছে যা অভিভাবকদের একেবারেই এড়িয়ে যাওয়া উচিৎ নয়।

এই পরিবর্তন কিশোর বয়সী সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে তাদের আগেভাগে সঙ্কেত দিতে পারে। কয়েকটি লক্ষণ ও আচরণগত পরিবর্তন সম্পর্কে ধারণা দিলেন তিনি।

প্রাণবন্ত ছেলে মেয়েদের হঠাৎ করে মন মরা হয়ে যাওয়া, নিজেকে গুটিয়ে ফেলা, কথা বলা ও মানুষের সাথে মেলামেশা কমে যাওয়া, আবেগ ওঠা নামা করা, যে কাজে আনন্দ লাগতো সেটিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, দ্রুত বিরক্ত হওয়া, ঘরের ভেতরে দরজা বন্ধ করে বসে থাকা, রাতে জেগে থাকা এবং দিনে ঘুমানো, মৃত্যুর কথা বলা, নিজের ক্ষতি করার চেষ্টা করা, একা একা কথা বলা ও হাসা, যারা শান্ত ছিল তারা হঠাৎ অতিরিক্ত কথা বলতে শুরু করা।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভিভাবকদের এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, "তাকে কথা বলার সুযোগ দিতে হবে। তার পাশে তারা আছেন সেভাবে আশ্বস্ত করতে হবে। বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে তাকে কিছু না লুকিয়ে সরাসরি পরিবর্তনগুলো ব্যাখ্যা করতে হবে। ইতিবাচক কিছুতে আগ্রহী করে তুলতে হবে। এরকম অনেক কিছুই অভিভাবকেরা করতে পারেন।

তবে সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, যে আচরণগত পরিবর্তনগুলো উল্লেখ সেগুলো খেয়াল করলে বিশেষজ্ঞের কাছে অবশ্যই নিয়ে যেতে হবে। শাসন করলে, বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে এমন কথা বলা চলবে না।"

মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরও এসব লক্ষণ বোঝার গুরু দায়িত্ব রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে বড় শহরগুলোতে হাতে গোনা দু একটি ছাড়া স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবার কোন ধরনের ব্যবস্থা নেই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন