যক্ষ্মা : উপসর্গ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ করার উপায়

যক্ষা (Tuberculosis বা টিবি) একটি সংক্রামক রোগ। মাইকোব্যাক্টেরিয়াম টিউবারকিউলোসিস (Mycobacterium tuberculosis) নামক একটি জীবাণু এই রোগের জন্য দায়ী। ‘যক্ষ্মা’ শব্দটা বাংলা ‘রাজক্ষয়’ শব্দ থেকে এসেছে। যক্ষ্মায় আক্রান্ত রোগীরা খুব রোগা হয়ে পড়েন। যক্ষ্মা রোগে সবচেয়ে বেশী আক্রান্ত হয় ফুসফুস, যদিও হৃৎপিণ্ড, অগ্ন্যাশয়, ঐচ্ছিক পেশী ও থাইরয়েড গ্রন্থি ছাড়া শরীরের প্রায় যেকোনও অঙ্গেই যক্ষ্মা রোগ হতে পারে এমনকি কিডনি, মেরুদন্ড অথবা মস্তিষ্ক পর্যন্ত আক্রান্ত হতে পারে। যক্ষায় সংক্রমিত প্রতি দশ (১০) জনের মধ্যে একজনের সক্রিয় যক্ষা হতে পারে। পৃথিবীর যক্ষ্মা রোগীদের প্রায় এক তৃতীয়াংশেরও বেশী ভারতীয় উপমহাদেশে বাস করে। জীবাণু শরীরে ঢুকলেই কিন্তু যক্ষ্মা হয় না। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হলে যক্ষ্মা হওয়ার সম্ভবনা বেশি থাকে।



যক্ষার লক্ষণ ও উপসর্গসমূহ

ফুসফুসে আক্রান্ত যক্ষ্মার ক্ষেত্রে,
•সাধারনত তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কাশি
•জ্বর
•কাশির সাথে কফ এবং রক্ত আসলে
•বুকে ব্যথা অথবা শ্বাস নেয়ার সময় অথবা কাশির সময় ব্যথা হওয়া
•ওজন কমে যাওয়া
•শারীরিক দুর্বলতা
•ক্ষুধামন্দা বা খাদ্যে অরুচি
•অবসাদ অনুভব করা

ফুসফুস বহির্ভূত যক্ষ্মার ক্ষেত্রে,
•অন্ত্র ও খাদ্যনালীর যক্ষ্মার লক্ষণগুলো হল পেটফাঁপা, পেটব্যথা, ক্ষুধামন্দা, বদহজম, পেটের মধ্যে বুটবাট শব্দ হওয়া আবার কখনও কখনও পাতলা পায়খানা, খাবারে অরুচি ইত্যাদি।
•চামড়ায় যক্ষ্মা হলে চামড়া ফুলে যায়, লাল হয়ে ওঠে, ঘা হয় এবং কালো কালো দাগ হতে পারে। ঘা এর মাঝখানে কিছুটা নিচু থাকে।
•অ-কোষ এবং এর আনুষঙ্গিক অঙ্গে যক্ষ্মা হলে অ-কোষ ও এপিডিডামিস ফুলে যায়, ব্যথা হয়।
•গান্ড আক্রান্ত হলে গান্ড ফুলে যায়, লাল হয়ে যায় এবং ব্যথা হয়। শরীরের বিভিন্ন গান্ডের মধ্যে থেকে সাধারণত ঘাড়ের গান্ডগুলোতেই এই যক্ষ্মা বেশি হতে পারে।
•কিডনি আক্রান্ত হলে পেটের পেছনের দিকে কিডনির অবস্থানে ব্যথা হয়। পেশাবের সঙ্গে রক্তপাত হতে পারে তবে অনেক সময় তা খালি চোখে দেখা যায় না। প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া এবং ঘন ঘন প্রস্রাব হয়।
•জয়েন্ট, হাড় অথবা শিরদাড়া আক্রান্তের ক্ষেত্রে আক্রান্ত অঙ্গ ফুলে যাবে, ব্যথা হবে এবং শিরদাড়া বাঁকা হয়ে যেতে পারে।
•কখনও কখনও যক্ষ্মার কারণে ফুসফুসের অন্ত ও বহিরাবরণের মধ্যে এক ধরনের তরল জমে এটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পানির মতো দেখা যায় আবার কখনও রক্ত বা দুধের মতো দেখা যেতে পারে। একে বলা হয় পরাল ইফিউশন আবার একই কারণে হৃৎপিণ্ডেও এ ধরনের পদার্থ জমতে পারে। একে পেরিকার্ডিয়াল ইফিউশন বলে। এর ফলে বুকে ব্যাথা হয়, বুক ধড়ফড়, জ্বর, শ্বাস কষ্ট ও কাঁশি হতে পারে।
•যুবতী মেয়ের কোন কারণ ছাড়াই হঠাৎ মাসিক বন্ধ হয়ে গেলে, তার জরায়ুতে যক্ষ্মা হয়েছে বলে অনুমান করা হয়। আবার মেয়েদের যৌনাঙ্গ, জরায়ু ইত্যাদি অঙ্গে আক্রান্তের ক্ষেত্রে তলপেটে ব্যথা হয়, দুই পাশে বেশি ব্যথা হতে পারে এবং পেটে হাত দিলে অনেক সময় শক্ত কিছু অনুমিত হতে পারে।

যক্ষ্মা : উপসর্গ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ করার উপায়

মনে রাখতে হবে, কারও শরীরে যক্ষ্মার সাধারণ লক্ষণসমূহ দেখা দিলে আর বিলম্ব না করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে কারণ এই অবস্থায় যে কোন লোকেরই যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

যক্ষা রোগের জীবাণু যেভাবে ছড়ায়
 বাতাসের মাধ্যমে যক্ষা রোগের জীবাণু ছড়াতে পারে। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে রোগের জীবাণু বাতাসে মিশে যক্ষা রোগের সংক্রমণ ঘটায়। যক্ষ্মা রোগীর প্লেট, গ্লাস এমনকি বিছানা আলাদা করে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এটি যেহেতু হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে ছড়ায়, তাই যার এ রোগ আছে তাকে কিছু ব্যপারে সতর্ক হতে হবে। যেমন- হাঁচি বা কাশির সময় মুখে রুমাল দেওয়া, হাত দিয়ে মুখ ঢাকা অথবা একদিকে সরে কাশি দিতে হবে। যেখানে সেখানে থুতু বা কফ ফেলা যাবে না। আক্রান্ত ব্যক্তির মুখের কাছাকাছি গিয়ে কথা বললে এ রোগের জীবাণু ছড়াতে পারে।

এই ব্যাপারগুলো সাধারণত চিকিৎসা শুরুর প্রথম চার সপ্তাহেই প্রয়োজন হয়। এরপর রোগী যদি পূর্ণ মাত্রায় চিকিৎসা নেয় তাহলে আর কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। চিকিৎসা শুরুর চার সপ্তাহের মধ্যেই সে সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত হয়ে যাবে। এটি যেহেতু গ্লাস, প্লেট বা তোয়ালে দিয়ে ছড়ায় না তাই এ ধরনের রোগীকে আলাদা ঘড়ে রাখার কোন যুক্তি নেই এবং কোনভাবেই উচিত নয়।

রোগ নির্নয়ের জন্য যে ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে
•রক্তের পরীক্ষা
•কফ পরীক্ষা
•ত্বকের পরীক্ষা
•বুকের এক্স-রে
•সিটি স্ক্যান
•কালচার টেস্ট

অনেক সময় পরীক্ষার ফল নেতিবাচক হলেও যক্ষার সংক্রমণ হতে পারে। যেমন-
•সাধারনভাবে যক্ষা সংক্রমণের ৮ থেকে ১০ সপ্তাহ পর তা ত্বকের পরীক্ষায় ধরা পড়ে। তার আগে পরীক্ষা করলে রোগ ধরা নাও পড়তে পারে।
•শরীরে যক্ষা রোগের জীবাণু বেশী মাত্রায় ছেয়ে গেলে ত্বকের পরীক্ষায় এ রোগের জীবাণু ধরা নাও পড়তে পারে।
•হামের টিকা নিলে এগুলোতে অনেক সময় জীবন্ত জীবাণু থাকে, এর জন্য ত্বক পরীক্ষায় যক্ষার জীবাণু ধরা নাও পড়তে পারে।
•এইডস এর মতো কোন রোগের কারণে রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে অনেক সময় পরীক্ষায় যক্ষা রোগ ধরা নাও পড়তে পারে আবার এইডস এবং যক্ষা রোগের লক্ষণ ও উপসর্গ গুলো প্রায় একই রকম হওয়ায় এইডস রোগীদের যক্ষা রোগ নির্ণয়ের বিষয়টি জটিল হতে পারে।

কাদের যক্ষা হবার সম্ভাবনা বেশি?
যাদের যক্ষায় আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশি রয়েছেঃ
•অপুষ্টি
•রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যাদের কম।
•বয়স্ক ব্যক্তি
•যক্ষায় সংক্রমিত ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসা ব্যক্তি।
•যারা দীর্ঘদিন ধরে মাদক সেবন করছেন।

যক্ষ্মা রোগ প্রতিরোধের উপায়
 যক্ষ্মা বা টিবি রোগের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে একজন সুস্থ ব্যক্তিকে নিম্মলিখিত বিষয়গুলোর ব্যপারে সাবধান হতে হবেঃ
•জন্মের পর পর প্রত্যেক শিশুকে বিসিজি টিকা দিতে হবে।
•পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হবে।
•বাসস্থানের পরিবেশ খোলামেলা, আলো-বাতাস সম্পন্ন হতে হবে।
•জনাকীর্ণ পরিবেশে বসবাস যথাসম্ভব পরিহার করতে হবে।
•ডায়াবেটিস জাতীয় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাসকারী রোগের ক্ষেত্রে, সুষ্ঠু চিকিৎসা নিতে হবে।
•যক্ষ্মা আক্রান্ত রোগীকে সবসময় নাক মুখ ঢেকে চলাচল করতে হবে।
•যক্ষ্মা জীবাণুযুক্ত রোগীর সাথে কথা বলার সময় একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
•রোগী জীবাণুমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত রোগীকে অন্য সবার থেকে একটু আলাদা রাখতে হবে।
•জীবাণুযুক্ত রোগীকে যেখানে সেখানে কফ ফেলা পরিহার করতে হবে।

যক্ষ্মা : উপসর্গ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ করার উপায়

যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসা
 যক্ষা রোগ ভালো হওয়ার জন্য সাধারণত ছয় মাসের চিকিৎসা করা হয়। প্রথম দুই(২) মাস চার ধরনের ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। পরবর্তী চার মাস দুই ধরনের ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। সাধারণত যক্ষার ওষুধ কিছুদিন খাওয়ার পর শতকরা ৮০ ভাগ লক্ষণ চলে যায়। তখন রোগী ভাবে সে হয়তো সম্পূর্ণ ভালো হয়ে গেছে এবং ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দেয়। এর ফলাফল মারাত্মক হতে পারে। এ রকম পরিস্থিতি হলে, অন্যরকম চিকিৎসা শুরু করতে হয়। তখন ৫টা ওষুধ দিয়ে পুনরায় চিকিৎসা আরম্ভ করতে হয়।

যক্ষার চিকিৎসায় প্রথম দুই মাস যে চারটি ওষুধ দেওয়া হয় তা নিয়মিত খেতে হবে। একদিনও বাদ দেওয়া যাবে না এবং সঠিক পরিমাণে খেতে হবে। সাধারণত রোগীর ওজন অনুযায়ী ওষুধের পরিমাণ নির্ধারিত হয়ে থাকে।

অনেক ক্ষেত্রে, যক্ষার কিছু কিছু ওষুধের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ায় অনেকেরই চোখ হলুদ হয়ে যায় অথবা বমি বমি ভাব হয়। তখন অনেক রোগীই ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দেন। যক্ষার যদি সঠিকভাবে চিকিৎসা করা হয় তবে এটি এখন মারাত্মক কোনো রোগ নয়। কিন্তু সঠিক চিকিৎসা না হলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

যক্ষা রোগের ওষুধ
 যক্ষা রোগের চিকিৎসায় সাধারণত রিফাম্পিসিন, পাইরাজিনামাইড, আইসোনিয়াজিড, ওফ্লক্সাসিন, ইথামব্যুটল, স্ট্রেপ্টোমাইসিন, ইথিওনামাইড, রিফাবিউটিন,, সাইক্লোসেরিন, প্যারা অ্যামিনো স্যালিসিলেট ইত্যাদি ঔষধের ব্যবহার হয়।

সবশেষে
 এক সময়ে আমাদের সমাজে প্রচলিত একটি বাক্য ছিল “যার হয় যক্ষা তার নাই রক্ষা”। যক্ষ্মা আক্রান্ত ব্যক্তি ছিল সমাজে প্রচণ্ডভাবে অবহেলিত। রোগের জটিলতা এবং সামাজিক অবহেলা এ দুইয়ে মিলে আক্রান্ত ব্যক্তি ধীরে ধীরে মৃত্যুবরণ করতো। সুনির্দিষ্টভাবে এ রোগের কারণ জানা না থাকার কারনে চিকিৎসা করা সম্ভব হত না। কিন্তু বর্তমানে এ রোগের জীবাণু আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। এখন এ রোগের আধুনিক চিকিৎসা আছে। সঠিকমাত্রায়, নিয়মিত এবং পূর্ণ মেয়াদের চিকিৎসায় যক্ষা রোগ সম্পূর্ণ ভাল হয়।

কথায় আছে – রোগ বালাই বলে কয়ে আসে না। কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। যেকোনো অসুখ মারাত্মক আকার ধারণ করার আগে নানা ধরণের উপসর্গ দেখা দেয়। আমরা অনেক ক্ষেত্রেই সেসব উপসর্গকে গুরুত্ব সহকারে দেখি না। ফলে সম্ভাব্য ঝুঁকি এড়ানো যায় না। অথচ সামান্য একটু সচেতনতাই পারে যেকোনো অসুখ প্রকট আকার ধারণ করার আগে আরোগ্য লাভের ক্ষেত্রে সাহায্য করতে। এ লক্ষে ই হাসপাতাল নিরসল কাজ করে যাচ্ছে। আমরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন অসুখের কারণ, লক্ষন ও প্রতিকার নিয়ে সাধারন মানুষকে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। আপনি চাইলে আপনার কি অসুখ হয়েছে বা হয়ে থাকতে পারে তা আমাদের ব্লগের রোগ ডিরেক্টরি থেকে বের করতেন। অথবা সরাসরি আমাদের কাছে ফোন করতে পারেন এই সংক্রান্ত পরামর্শের জন্য।

যেকোনো রোগে সময় স্বাস্থ্যসেবা আছে আপনার হাতের কাছেই! ই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠানটির মূল লক্ষ হচ্ছে সকল প্রকার স্বাস্থ্যসেবা সাধারণ দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া, চিকিৎসা বিষয়ক সুপরামর্শ প্রদান করা, বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যবস্থা করে দেওয়া, প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি ও সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা, দুর্লভ ঔষধ সমুহের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা, সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন করার লক্ষে কাজ করে যাচ্ছে ই হাসপাতাল।

জরুরী মুহূর্তে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার জন্য অথবা আপনার স্বাস্থ্য সংক্রান্ত যেকোনো সমস্যার সমাধান পাওয়ার জন্য আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন।