সত্যই কি স্তন্যদানকারী মায়েদের বুকের দুধ কম হয় !

বুকের-দুধ-সত্যই-কি-কম-হয়!
ছবিঃঅনলাইন থেকে সংগৃহিত

নবজাতক বিশেষজ্ঞ হিসাবে সবচেয়ে বেশী সময় দিতে হয় স্তন্যদানকারী মায়েদের কাউন্সিলিং-এ।
সবচেয়ে সমস্যা হয়, বাচ্চা জন্মের প্রথম ২-৩ দিন বয়স পর্যন্ত! কারণ এই সময় শাল দুধ হয়, যার পরিমাণ ২৪ ঘন্টায় মাত্র ১-২ চামচ সমপরিমাণ। ফলে মায়েদের ধারণা, বাচ্চা দুধ পাচ্ছে না। অথচ এই সামান্য দুধেই আছে নবজাতকের সম্পূর্ণ পুষ্টি। শুধু তাই নয়, এই দুধে আছে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। আর তাই শাল দুধকে নবজাতকের প্রথম ভ্যাকসিনও বলা হয়।

এছাড়াও জন্মের প্রথম ৪৮ ঘন্টা প্রস্রাব না হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু বাচ্চা যদি জন্মের ১০-১২ ঘন্টার মধ্যে প্রস্রাব না করে, মা-বাবা/বাড়ির মুরুব্বি অস্থির হয়ে যান। আর প্রথম মা হলে তো, আরও বেশী দুশ্চিন্তা-
গ্রস্ত হয়ে পড়েন। একদিকে শাল দুধ, যা পরিমাণে অত্যন্ত অল্প - তার সাথে যদি বাচ্চা কান্না করে- মা,
মুরুব্বিদের প্রথম অভিযোগ থাকে বাচ্চা বুকের দুধ পাচ্ছে না।

ফলে এই প্রথম ২৪-৪৮ ঘন্টার মধ্যেই বেশীর ভাগ নবজাতক বাহিরের দুধ (Infant formula) পেয়ে থাকে। অথচ খুউব সহজেই এই সময়ে মাকে কাউন্সিলিং করলে, এই অন্যায় প্রতিরোধ করা সম্ভব।
আবার ৩ সপ্তাহ বয়স হতে, বাচ্চারা শিশুসুলভ উদরাশূল (Infantile colic) নামে একধরনের পেট ব্যথায় কান্না করে। যার প্রধান কারণ বুকের দুধের সাথে সাথে বাচ্চা বাতাস (Air) গিলে ফেলে।

অনেক মায়েরাই এই সমস্যাকে গ্যাসের সমস্যা মনে করে থাকেন। ফলে অনেক মা এসেই বলেন বাচ্চার জন্ম থেকেই গ্যাসের সমস্যা আছে। আবার অনেকে মনে করেন, বাচ্চা দুধ পাচ্ছে না, তাই কান্না করে। অথচ এই রোগের চিকিৎসাই হলো পেট থেকে বাতাস বের করে দেওয়া। যার কারণে ব্যথা, সেই কারণের (বাতাস) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।

ফলে এখানে কাউন্সিলিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে, মায়েরা বুকের দুধ কম হচ্ছে মনে করে বাহিরের দুধ (Infant formula) খাওয়ানো আরম্ভ করে। ফলে মাকে পেটের ব্যথার কারণ এবং কিভাবে পেট থেকে বাতাস বের করতে হয়, তা বুঝিয়ে বলতে হয়।

বাহিরের দুধ (INFANT FORMULA) কে কেন অন্যায় বলেছি!
অন্যায় বলার পিছনে সবচেয়ে বড় কারণ - চিকিৎসা বিজ্ঞানে আছে, নবজাতক প্রথম ৬ মাস পর্যন্ত শুধুমাত্র বুকের দুধ খাবে। এমন কি এক ফোঁটা পানি পর্যন্ত খাওয়ানো নিষেধ।
৬ মাস বয়স পর্যন্ত শুধুমাত্র বুকের দুধের বহু উপকারিতা আছে! যদি সংক্ষেপেও বলি তাহলেও লেখা অনেক বড় হয়ে যাবে। কিন্তু আমার এলেখার উদ্দেশ্য বুকের দুধের উপকারিতা নিয়ে নয়। তাই সে আলোচনায় যেতে চাচ্ছি না।
বুকের দুধ কম হওয়ায় বা বাহিরের দুধ (Infant formula) বাচ্চার স্বাস্থ্যের জন্য ভাল এধরণের কোন কারণ দেখিয়ে, যদি বাচ্চাকে কেউ বাহিরের দুধ খাওয়ানোর উপদেশ দেয়, তার জন্য সরকার কঠোর আইন করেছে। যা অনেক স্বাস্থ্যকর্মী/অভিভাবক জানেন না।

BREASTMILK SUBSTITUTES ACT 2013
এই আইনে বলা আছে - কোন স্বাস্থ্যকর্মী (চিকিৎসক/নার্স বা মায়ের সেবায় নিয়োজিত কোন ব্যক্তি) অথবা কোম্পানির লোকজন, বুকের দুধের পরিবর্তে অন্য কোন দুধ (Infant formula) খাওয়ার জন্য উপদেশ দেয় বা উৎসাহিত করে (এমন কি শুধুমাত্র লিফলেট বিলি করলেই অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে), তার জন্য ফৌজদারি অপরাধে দন্ডিত হবেন!

এই আইনে অপরাধী কোন জামিন পাবেন না। শুধু তাই নয় - অন্য যেকোন আইনই থাকুক না কেন, তাহাতে এই অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে কোন প্রভাব ফেলবে না।

দন্ড-

অপরাধ সংঘটিত হলে -
  • ১) প্রথমবার অপরাধ করলে - ৩ বছরের জেল অথবা ৫ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন।
  • ২) পরবর্তীতে একই অপরাধ করলে - শাস্তি দিগুণ হবে। বারে বারে করতে থাকলে, প্রতিবারই আগের বারের দিগুণ শাস্তি ভোগ করতে হব।
  • ৩) যদি এই অপরাধে বাচ্চা অসুস্থ অথবা মৃত্যু হয় - তাহলে ১০ বছরের জেল/৫০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। এই অর্থ ক্ষতিগ্রস্ত বাচ্চার পরিবার পাবে।
উপরের আলোচনায় বুঝা গেল - কাউকে বাহিরের দুধ (Infant formula) খাওয়ার উপদেশ দেওয়া বা খাওয়াতে উৎসাহিত করা ফৌজদারি অপরাধ!
 
তাহলে এই দুধ কেন বাজারে পাওয়া যায়?

এই বাহিরের দুধ (Infant formula) লেখার কিছু absolute indication অকাট্য কারণ আছে-
  • ১) বাচ্চার জন্মের সাথে সাথে মা মারা গেলে বা পালক নবজাতক বাচ্চা হলে!
  • ২) মা যদি ক্যান্সারের ঔষধ পায়!
  • ৩) কিছু কিছু জন্মগত ত্রুটি - যেমন গ্যালাকটোসেমিয়া (Galactosemia) যেখানে বুকের দুধ খেলে বাচ্চা অন্ধ হয়ে যায়।
  • ৪) মা যদি অ্যান্টিথাইরয়েড ওষুধ (Antithyroid drugs) পায়।
  • ৫) মা যদি অ্যান্টিসাইকোটিক ড্রাগ (antipsychotic drug) পায়। অনেকে relative contraindications বলে থাকেন।
আরও কিছু কারণ আছে।
  • কিন্তু মা হেপাটাইটিস বি ভাইরাস/করোনা পজিটিভ, এইডস রোগে আক্রান্ত বা যক্ষা রোগ হলেও বুকের দুধ খাওয়াতে নিষেধ নাই। এইদেশের পরিপ্রেক্ষিতে অবশ্যই এইসব রোগে বুকের দুধ খাওয়াবেন। সেক্ষেত্রে অবশ্যই শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিবেন!
উপরোক্ত absolute indication আছে বলেই - এখনো বাজারে বাহিরের দুধ (Infant formula) বাজারে এখনো পাওয়া যায়। নাহলে, হয়তো এদেশে এইসব দুধ নিষিদ্ধ হতো।

এছাড়াও পরিমিত বুকের দুধ হওয়ার জন্য বেশকিছু ব্যবস্থা নেওয়া আবশ্যক -
  • ১) মায়ের নির্জন স্থান (Privacy)। মা বুকের দুধ খাওয়ানোর সময়, অবশ্যই নির্জনস্থানের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
  • ২) জন্মের এক ঘন্টার মধ্যে বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। কারণ এই সময় সবচেয়ে ভাল দুধ চোষার ক্ষমতা (Sucking reflex) থাকে। তারপর এই ক্ষমতা কমতে থাকে।
  • ৩) স্বাভাবিক অবস্থায় মা যতটুকু খাবার খেতেন - তার দেড় গুণ বেশী খাবার খাবেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় - আগে যদি মা এক প্লেট (থালা) ভাত খেতেন, বুকের দুধ পরিমাণ মত হওয়ার জন্য দেড় প্লেট ভাত খাবেন। দুই টুকরো মাছ/মাংস খেলে - এখন তিন টুকরো খাবেন।
  • ৪) মা প্রতিদিন পূর্ণ ক্রিম (Full cream)গরুর দুধ খাবেন। কারণ বাচ্চা বুকের দুধ খাওয়ায় মায়ের প্রয়োজনীয় ক্যালসিয়াম এবং ফসফেটের ঘাটতি পূরণ করতে হবে।
  • ৫) প্রতিদিন প্রচুর পানি খাবেন। কারণ বুকের দুধে প্রচুর পরিমাণে মায়ের শরীরের পানি খরচ হয়।
  • ৬) পজিশন (Position) এবং  সংযোজন (Attachment ) নতুন মায়ের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় উপদেশ। এমন কি, অনেক সময় একমাত্র কারণ। বাচ্চা কি ভাবে ধরবেন এবং অবশ্যই স্তন এর কালো অংশ যেন মুখের ভিতর থাকে। এই বিষয়ে সব মাদেরই উচিৎ একজন নবজাতক/শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া।
  • ৭) রাতে অবশ্যই বুকের দুধ খাওয়াবে, কারণ বুকের দুধ রাতে বেশী হয়। প্রোল্যাক্টিন (Prolactin) হরমোন, যার কারণে বুকে দুধ হয়, রাতে বেশী সিক্রেশন (secretion) হয়।
  • ৮) প্রতিবার বুকের দুধ খাওয়ানোর পর বাচ্চার ঢেকুর তুলবেন। না হলে, বাচ্চা পেটের ব্যথায় কান্না করবে (Infantile Colic), আর মা মনে করবে - বাচ্চা বুকের দুধ পাচ্ছে না।
  • ৯) অনেক ক্ষেত্রে স্তন এর বিভিন্ন রোগ যেমন- স্তন ফুলে ব্যথা/বোটা (Nipple) ফেটে যাওয়া, ফোঁড়া ইত্যাদি সমস্যায় চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন।

মায়েদের কিছু প্রশ্নের উত্তরঃ
১) প্রথম ২-৩ দিন বুকের দুধ কম পাওয়ায়, মায়েরা বাহিরের দুধ দাবি করে। কোন দুধটি ভাল হবে?
  • উত্তরে বলি - যদি প্রথম ২/৩ দিন, শাল দুধ না হয়ে, স্বাভাবিক দুধ আসে, তাহলেই তো সমস্যা! কেন স্বাভাবিক দুধ আসলো? কারণ এই প্রথম ২-৩ দিন শাল দুধই আসতে হবে। ফলে প্রথম ২-৩ দিন দুধ বেশী হওয়ার কোন সম্ভাবনা নাই। কারণ এই সময় শাল দুধই প্রয়োজন। আর বেশী দুধ হওয়া অস্বাভাবিক!
২) বাচ্চা দুধ কম পাওয়ায় শুধু কান্নাকাটি করে!
  • উত্তরে বলি - বাচ্চা কান্নাকাটি আর বুকের দুধ (Suck) পান করা শিখেই পৃথিবীতে এসেছে। ফলে বাচ্চা শুধু ক্ষুধার জন্য কান্না করে না। প্রস্রাব/পায়খানা করলে, গরম/ঠান্ডা লাগলে বা এমন কি মায়ের কোলে যাওয়ার জন্যও কান্না করে! তার হাসতে শিখতে সময় লাগবে!
৩) বুকের দুধ বা ফিডার দিলে তো কান্না থেমে যায়?
  • উত্তরে বলি - মুখ তো একটা, সেখানে একটি আঙুল দিলেও কান্না থেমে যাবে! যদি দুটো মুখ থাকতো - তাহলে এক মুখে কান্না করতো, আরেক মুখে হয়তো ফিডার খেতো! আর বাচ্চাতো এই স্তন্য-চোষা (Suck করা) শিখেই পৃথিবীতে এসেছে। ফলে মুখে কিছু দিলেই চুষতে থাকবে।
৪) বাচ্চা খাওয়ালেও শুধু কান্না করতেই থাকে!
  • উত্তরে শিশুসুলভ উদরাশূল - (Infantile Colic) সম্পর্কে বলি - Role of  3 (Three), বুঝাই। বেশীর ভাগ মা, স্বীকার করে নেন - কাঁধে তুলে রাখলে, কিছুক্ষণ পর কান্নাকাটি কমে যায়।
আরও বলি পৃথিবীতে এমন কোন রোগ বা ঔষধ নাই, যার কারণে বুকের দুধ কমে যায়! একজন মা একসাথে তিনজন বাচ্চার প্রয়োজনীয় বুকের দুধ দিতে পারে। যা পরীক্ষীত!

এছাড়াও মাদের বলি - আচ্ছা মা, আপনি যদি বাহিরের দুধ কিনতে যান, কার টাকা খরচ হয়?
নিশ্চয়ই আমার টাকায় কিনেন না! তাহলে আমি কেন না করি?

কারণ আপনার বাচ্চার ক্ষতি হউক, আমি চাই না! আর এই বিষয় দেখাই আমার দায়িত্ব!
যদি কেউ দুধ লিখে দেয় - তিনি তার সঠিক দায়িত্ব পালন করেন নাই! আর একটা কারণ হতে, পারে আপনাদের (মাদের) বললাম না।

সবশেষে মাদের জিজ্ঞেস করি- বাচ্চা ঠিকমত বুকের দুধ পাচ্ছে বা পাচ্ছে না, তা কি ভাবে বুঝবেন?
প্রায় সবাই কান্নাকাটি করা বা না করার কথা বলেন! (যদিও একটি কারণ)

তাদের বলি - বাচ্চা যদি ২৪ ঘন্টায় ৬ বার বা তার বেশী প্রস্রাব করে এবং সঠিক ভাবে ওজন বাড়ে, তাহলেই বুঝতে হবে, বাচ্চা পরিমাণ মত দুধ পাচ্ছে (আমি এই দুটি কারণকে প্রাধান্য দিয়ে থাকি)।

এই কথায় প্রায় সব মা বলেন - প্রস্রাব তো দিনে ১৫/২০ বার করে! তখন বলি - মা বাতাস খেয়ে কি এতো বার প্রস্রাব সম্ভব? নিজের (মা) ক্ষেত্রে দেখবেন - যেদিন কম পানি খাবেন, সেদিনই প্রস্রাব কমে যাবে।
সবশেষে বলতে চাই - বাচ্চার কান্না করা মানেই, বুকের দুধ কম পাওয়া নয়।


=> তথ্য সমুহ ঃ 

তথ্য কারটেসিঃ-

ডাঃ মোহাম্মদ নেয়ামত হোসেন
এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর
নিওনেটোলজি, বিএসএমএমইউ


১। FACEBOOK অফিস।
২। Google